কুদালে বুক টানে, কখনো পিঠ টানে না!

মোঃ মাসুম হোসন •

স্বজনপ্রীতি হল আমাদের সমাজের খুব সাধারণ একটা ব্যাপার, যার প্রভাব বর্তমান সমাজে অনেক বেশি পরিমাণে পরিলক্ষিত হয়। রাজনীতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন অফিস আদালত এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ প্রায় সব জায়গাতেই আজ কাল স্বজনপ্রীতি দেখা যায় খুব বেশী। বিশেষ করে নিজ স্বার্থে কার্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির প্রভাব চোখে পড়ার মতো। স্বজনপ্রীতি আমাদের সমাজে একটি মরণব্যাধির রূপ ধারণ করেছে। চাকরি, ব্যবসা, রাজনীতি, প্রশাসন, সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে এ স্বজনপ্রীতি। এটি ধ্বংস করে দিয়েছে ন্যায়বিচার, ন্যায়নীতি ও নিরপেক্ষতার আদর্শকে।
আমরা যে যেই দায়িত্বে থাকি চেষ্টা করি, নিজেদের আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিতদের একটু প্রাধান্য দিতে, একটু সুযোগ-সুবিধা দিতে। যা মোটেও কাম্য নয়। দুর্নীতির অন্যতম কারণও এই স্বজনপ্রীতি। ইসলাম সর্বক্ষেত্রেই স্বজনপ্রীতি থেকে দূরে থেকে ন্যায়নীতি গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ন্যায়বিচারে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহর সাক্ষী স্বরূপ; যদিও তা তোমাদের নিজেদের অথবা মা-বাবা এবং আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে হয়।’ (সূরা নিসা : ১৩৫)
প্রিয় নবী সা: ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি স্বজনপ্রীতির প্রতি লোকদের ডাকে, নিজেও স্বজনপ্রীতি করতে গিয়ে যুদ্ধ করে এবং স্বজনপ্রীতির সমর্থনে মারা যায়, সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (সুনানে আবু দাউদ-৫১২১) এই আয়াত ও হাদিস থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, মুসলমান স্বজনপ্রীতি করতে পারে না। নিজের দলীয় লোকজন, পরিচিতজন বা আপনজনকে অন্যের ওপর প্রাধান্য দিতে পারে না। মানুষের অভ্যাস হলো, নিজের লোকজন কোনো বড় অন্যায় করলেও তা চোখে পড়ে না। ধরা পড়লেও তেমন অপরাধ মনে হয় না। তাই এর বিচারও হয় না।
কিন্তু অন্য কেউ ছোটখাটো অন্যায় করলেও তা অনেক বড় মনে হয়। তার বিচার করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। করতে চায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা।
প্রাচীন সমাজ এবং দাস সমাজের মানুষ যদিও বর্বর ছিল কিন্তু স্বজনপ্রীতির উপস্থিতি ছিল খুবই কম। মধ্যযুগের সামন্ত সমাজ ব্যবস্থার শুরু থেকে ১৭ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত স্বজনপ্রীতির উৎপত্তি ও বিকাশ কাল হিসেবে ধরা হয়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বজনপ্রীতি বলতে শুধু নিজের মানুষের প্রতি ভালোবাসা বুঝায়, সকলের যোগ্যতা অনুযায়ী প্রাপ্য না দিয়ে নিজের ভালোবাসার মানুষকেই প্রাপ্যটা বেশী দেয়াকে বুঝায়। অর্থাৎ কোনও একটি পেশাতে অনেক যোগ্য প্রার্থী থাকা সত্বেও নিজের পরিচিতি ও জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে নিজের কাছের লোকের সুবিধা দেয়া। কারণ স্বজন বলে কথা। স্বজনকে যেমন সবাই ভালোবাসা দিতে চায় আবার তাদের কাছে ভালোবাসা পেতেও চায়। এ ভালোবাসা নিজের বাড়িতে বা স্বজনের বাড়িতেই কেবল গ্রহণীয়। তবে নিজের পছন্দসই লোক নিয়োগ দেয়া অনেক সময় স্বজনপ্রীতির মধ্যে পরে না। বর্তমানে প্রাইভেট কোম্পানিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কর্তা ব্যক্তিরা সাধারণত নিজস্ব রেফারেন্সের মাধ্যমেই কর্মী নিয়োগ করতে পছন্দ করে। নিজস্ব রেফারেন্সের মাধ্যমে নিয়োগ হলে নিজেদের মধ্যে বুঝাপড়া ভালো হয় যার ফলশ্রুতিতে কাজের গতি বাড়ার সাথে সাথে প্রোডাক্টিভিটি বৃদ্ধি পায়।
আবার অনেক সময় স্বজনপ্রীতির চকচকে পোশাকে নিজেকে বেশ সুন্দর মনে হলেও এই সৌন্দর্য বেশীদিন টিকে থাকে না।
যেখানে যতবেশী স্বজনপ্রীতি হবে সেখানে ততো হিংসা, বিদ্বেষ প্রশ্রয় পাবে এবং পারস্পারিক আস্থা ও বিশ্বাস উঠে যাবে, বাড়বে সন্দেহ। নিজেকে বাঁচাতে যেকোনো দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাবে। এভাবে এক সময় এ ধরণের অফিস থেকে মানবিক ও চারিত্রিক সব গুণাবলী মুছে যাবে। কর্মচারীরা এটিকে তাদের অনৈতিক কাজের অনুশীলনের উপযুক্ত সময় হিসাবে দেখতে পাবে, কারণ তারা বিশ্বাস করে যে তাদের কাছের বা আত্মীয় দ্বারা তাদের বিতাড়িত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। একবার যদি স্বজনপ্রীতি নামক ভাইরাস কোনো প্রতিষ্ঠানে ঢুকে তাহলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হতে পারে।
কিছু বড় বড় কর্মকর্তার নগ্ন প্রীতির ফলে অনেক যোগ্য লোকের ভোগান্তি হয়।
কর্মক্ষেত্রের ওইসব নেতারা বেমালুম ভুলে যান কোম্পানিটা তার নন, তার যেমন অধিকার অন্যান্য সকল কর্মীর তেমনি অধিকার। তিনি শুধু পদাধিকার বলে কোম্পানির দেখভাল করার দায়িত্ব পেয়েছেন মাত্র।

লেখক: মোঃ মাসুম হোসেন
শিক্ষার্থী, কক্সবাজার আইন কলেজ